বিশ্বজিত রায় ::
ভাঙাচুরা-খানাখন্দে পর্যুদস্ত সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়ক। ভাঙন অংশে বৃষ্টির পানি জমে গোটা সড়ক যেন ডোবা-নালায় রূপ নিয়েছে। লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াতনির্ভর সড়কটি এখন পথের কাঁটা। দুর্ভোগ-ভোগান্তি পুঁজি করে সড়কটিকে ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসে’ পরিণত করেছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। এ নিয়ে যাত্রী-চালক উভয়ের মাঝে চরম ক্ষোভ ও হতাশা আছে।
শুক্রবার সড়ক ঘুরে দেখা যায়, ৪০ কিলোমিটার রাস্তার প্রায় পুরোটাই বেহাল। সুনামগঞ্জ সদর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার কাঠইড়-শান্তিপুর-জয়নগর রাস্তার খানিক অংশে দায়সারা গোছের কাজ হয়েছে। তবে সংস্কারকৃত বেশকিছু অংশে বড় বড় ভাঙনের দেখা মিলেছে। জামালগঞ্জ অংশের রুপাখালী, নোওয়াগাঁও বাজার, বাহাদুরপুর, জাল্লাবাজ, উজ্জ্বলপুরের ভাঙাসহ তেলিয়া-শাহাপুর হয়ে জামালগঞ্জ উপজেলা সদর পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার রাস্তা পুরোটাই খানাখন্দে ভরপুর।
এছাড়া জামালগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে মান্নানঘাট-সেলিমগঞ্জ ও গজারিয়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়কের অনেক স্থানে ভাঙাচুরা ও খানাখন্দ আছে। সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জের এ রাস্তা দিয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। জানা যায়, ২০২২ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যা পূর্ববর্তী সড়কটি মোটামুটি চলাচল উপযোগী ছিল। তখনকার বন্যায় জামালগঞ্জের উজ্জ্বলপুর অংশে ভয়ঙ্কর ভাঙনের সৃষ্টি হলে জেলা শহরের সাথে উপজেলা সদরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সড়কটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) মোটা বরাদ্দের ঘষামাজায় কোনরকম চালু হলেও বন্যার ক্ষত এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দিন দিন এ ক্ষত আরও গভীর হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি ও রাজস্ব উন্নয়ন তহবিল থেকে জামালগঞ্জ অংশের উজ্জ্বলপুরের ভাঙায় কয়েক ধাপে ৩৮ লাখ, শাহপুর অংশের গর্ত মেরামতে ৫ লাখ, জামালগঞ্জ হাসপাতালের সামনের এইচবিবি রাস্তা মেরামতে ২৮ লাখ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তেলিয়া-শাহপুর ভাঙা অংশে ইটসলিংয়ে ৫ লাখ ও সেলিমগঞ্জ বাজার সংলগ্ন রাস্তা মেরামতে ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সময়ে সময়ে এ রাস্তার বিভিন্ন অংশে ইমার্জেন্সি মেইনটেন্যান্সের (জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ) নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জ সদর, শান্তিগঞ্জ ও জামালগঞ্জ উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কটি সুনামগঞ্জ ও সিলেটে জরুরি যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। এ রাস্তাটি ধর্মপাশা-মধ্যনগর উপজেলা ছাড়াও নেত্রকোণা জেলা একাংশের প্রায় লক্ষাধিক মানুষের চলাফেরায় গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। ভাঙন দুর্ভোগের কারণে মানুষ এ রাস্তা ছেড়ে বিকল্প পথ হিসেবে সুনামগঞ্জ-সাচনাবাজার সড়ক ব্যবহার করছে। এছাড়া এ সড়কের মধ্যস্থলে থাকা অন্তত ৫০টি গ্রামের মানুষ নিরুপায় হয়ে ঝুঁকি নিয়েই পথ চলতে বাধ্য হচ্ছে।
সড়কে যেতে যেতে কথা হয় ভীমখালী ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের মো. আলমগীর মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, এক্কেবারে নাজেহাল অবস্থা সড়কের। আমরা বড় বেকায়দায় আছি। প্রতিদিনই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটতাছে। জরুরি রোগী নিয়া কোথাও যাওয়া যায় না। মাঝে-মধ্যে একটু-আধটু ঘষামাজা কইরাই কাজ শেষ। কিন্তু পাবলিকের কোন উপকার হয় না।
ওই রাস্তায় চলাচলকারী পত্রিকা হকার মো. রাসেল জানায়, মাঝে মাঝে দেখছি একটু একটু কাজ হয়। এই কাজ মানে পেট ভরার কাজ। সড়কে ভাঙা তো ভাঙার জাগাতেই থাকে। কোন উপকার হয় না। ঠেলাইয়া-ধাক্কাইয়া কোনরকম গাড়ি চলে। আমরা এখনও ঠেলা-ধাক্কার মাঝেই আছি।
সড়কে ছবি তুলতে দেখে অটোরিকশায় চলাচলত এক নারী যাত্রী বলে উঠেন, ‘ভাই, ভালো কইরা ছবি তুলেন। এই রাস্তায় চলতে-ফিরতে আর ভালো লাগে না। অবস্থা খুব খারাপ।’ কোন প্রশ্নের অপেক্ষা না করে যাত্রীবাহী ওই অটোরিকশা চালক বলেন, ‘এই সড়কে চলতে গিয়া গাড়ির পার্টসের সাথে মানুষের পার্টসও নষ্ট হইয়া যায়। সবাই থাকে শুধু খাওয়ার ধান্দায়। কাজের ধান্দা কেউ করে না। ’ সুনামগঞ্জ থেকে এ সড়কে নিয়মিত যাতায়াতকারী ভীমখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ভাঙা রাস্তার কারণে নোয়াগাঁও যাই না। রুপাখালী থেকে নোয়াখালী ঘুরে ভীমখালী আসি। রুপাখালী-নোয়াগাঁও হয়ে জামালগঞ্জে যেতে তো ভয়ই করে। ইদানিং হুছননগর ও শান্তিপুরের মাঝখানে বেশকিছু জায়গা নষ্ট হয়েছে। মাঝে-মধ্যে রিপিয়ারিং হয়। তবে টেকসই কাজ না হলে ভোগান্তি দূর হবে না।
বিগত সময়ে এ রাস্তায় জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের নাম করে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে জানিয়ে ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আকতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, ২০২২ সালের বন্যায় ভাঙনের পর থেকে জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জ সড়কে খুবই নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিকবার যোগাযোগ করে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে এ রাস্তার বাস্তবায়ন চাই।
সুনামগঞ্জ এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কের কাজের জন্য চলতি অর্থবছরে টেন্ডার আহ্বান করা হবে। নোয়াগাঁও থেকে জামালগঞ্জ পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার রাস্তার সম্ভাব্য ইস্টিমেট ৯ কোটি ৮০ লাখ এবং জামালগঞ্জ থেকে মান্নানঘাট পর্যন্ত ৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। এছাড়া কাঠইড় থেকে রুপাখালী পর্যন্ত ছোটখাটো যে ভাঙন আছে সেগুলো ইস্টিমেটে ধরা আছে। ইমার্জেন্সি মেইনটেন্যান্সের (জরুরী রক্ষণাবেক্ষণ) ব্যাপারে তিনি বলেন, বড় বড় যে গর্ত ছিল সেগুলোতে ইট দেওয়া হয়েছে, তবে তা সামান্য। সরকার যে টাকা বরাদ্দ দেয় তার পরিমাণ কম। সেখানে অন্যকিছু করার সুযোগ নেই।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জের পথে পথে ক্ষত
লক্ষাধিক মানুষের সড়ক যেন ডোবা-নালা
- আপলোড সময় : ২০-০৮-২০২৫ ০৮:৪৫:৩১ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২০-০৮-২০২৫ ০৮:৫০:৫৬ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ